রাসেল ভাই -আবদুলস্নাহনজীব(আই,সি,ই)
পুরো নাম শেখ রাসেল । আমরা ডাকতাম গিট্রু ভাই বলে । অবশ্য সামনা সামনি কখনো ডাকার সাহস হয়নি। রাসেল ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচয় বাসে। শাহবাগ থেকে উওরা যাওয়ার পথে। আমি আর শাকিল কথা বলছিলাম নিউটনের তৃতীয় সূএ নিয়ে। ঠিক তখনই রাসেল ভাই পাস থেকে বলে উঠলেন, নিউটনের তৃতীয় সূত্র ভুল । আমরা কিছুতেই মানতে চাইলাম না । কিন্তু রাসেল ভাই আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে ব্যখ্যা দিয়ে চলেছেন । বাস ভর্তি লোকজন তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমার সাথে রীতিমত তর্কযুদ্ধ বেধে গেল । এভাবে গিট্্রু দিয়েই পরিচয় । রাসেল ভাই থাকতেন পুরোনো ঢ়াকার বকশিবাজার এলাকায় সিঙ্গেল এক রূমে। রূমে আসবাব পত্র তেমন ছিলনা । ফ্লোরে একখানা বিছানা ,ইলেকট্রিক হিটার আর চারপাসে ছড়ানো ছিটানো অসংখ্য বই।
যতবারই দেখা করতে গিয়েছি ততবারই তিনি বিখ্যাত হাজি বিরিয়ানী খাইয়েছেন আর জটিল সব গানিতিক সমস্যা আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা কেবল বিরিয়ানী খেয়েছি আর হুঁ হাঁ করে গেছি । রাসেল ভাই ছিলেন বিরাট হ্ৃদয়ের কিন্তু খুব অদ্ভুত একজন মানুষ। রাস্তায় হাঁটার সময় বিড় বিড় করে কি সব হিসাব করতেন । চারপশের কোন কিছু খেয়াল করতেন না। একারণে মহলার লোকজন তাকে আড়ালে অবডালে পাগলা রাসেল ডাকত। আবার তাকে খুব ভয়ও পেত। রাসেল ভাই কখনো মোবাইল কিংবা ফোনে কথা বলতেন না। তার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। কিন্তু সেখানেও ছিল বিপত্তি। চিঠিতে কোন বানান ভূল হলে লাল দাগ দিয়ে চিঠির জবাব সহ প্রেরকের কাছে ফেরত পাঠাতেন। বানান বেশি ভূল হলে লিখে পাঠাতেন ”একজন বাঙালীর এহেন ভাষা বিপর্যয় মোটেও কাম্য নহে। চিঠি লিখিবার সময় একখানা অভিধান সামনে রাখিবে”। এই ভয়ে আমি চিঠি খুব সংক্ষেপে লিখতাম । রাসেল ভাইয়ের অদ্ভুত আর এক অভ্যাস ছিল বিভিন্ন শ্রেণী পেষার মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া যেমন তাবলিগের বৈজ্ঞানিক নাম ”বদনাতাস তাবলিকাস”, ফাকিবাজ শিক্ষকদের নাম ”ফাকিটাস জ্ঞানেবাঁশ” ইত্যাদি। রাসেল ভাই কখনো মিথ্যা বলতেন না । যা সত্য পরম দুঃসাহসে তাই বলতেন ।
রাসেল ভাই মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতেন তবে ঘন্টা খানেকের বেশি বসতেন না। একদিন বললেন কয়েকদিন থকবেন। আমি বেশ খুশিই হয়েছি কারণ রাসেল ভাই মানেই মজার কোন কিছু ঘটা। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। রাসেল ভাই গোসল করতে ঢ়ুকেছেন গোসলখানায়। কিছুক্ষন পর বেরিয়েই চেঁচামেচি শুরূ করলেন । আমাকে বললেন গোসলখানায় লেবু নেই কেন । আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে ধমক দিয়ে বললেন ”লেবুতে আ্যসকারবিক এসিড আছে। আ্যসকারবিক এসিড কাপড় পরিস্কার করে। যা ঝটপট লেবুর ব্যবস্থা কর”। লেবুর ব্যবস্থা করা হল । রাসেল ভাই লেবু কচলে কাপড় ধুচ্ছেন আর আমরা ভাই বোন সবাই একজন একজন করে উকি দিয়ে দেখছি এই অদ্ভুত কাপড় ধোয়া । রাসেল ভাই পথ শিশুদের নিয়ে একটি স্কুল করেছিলেন যেখানে তিনি তাদের গনিত শেখানোর চেষ্টা করতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে আগামীদিনের অ্যাবেল,গ্যেলোয়া কিংবা রামানুজনের মত গণিতবিদ। তিনি অ্যলোহা পদ্ধতির মত একটি অভিনব পদ্ধতিতে বাচ্চাদের গণিত শেখাতেন। কেবল গণিতই নয় তিনি শিশুদের সামনে সহজ ভাষায় জাতিয় ইতিহাস ঐতিহ্য আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতেন। তিনি শিশুদের জন্য ছড়ায় ছড়ায় গণিত শেখানোর একটি বই লেখার কাজ শুরূ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মাতৃভাষায় গাণিতিক সমস্যা সমাধান করা সবচেয়ে সহজ। কিন্তু তা শেষ করতে পারেন নি। তার আগেই তাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল। আমরা রাসেল ভাইয়ের মত বড় মাপের মানুষ হতে পারবনা তবে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অন্তত কার্পণ্য করবনা। তাই এই ভাষার মাসে রাসেল ভাইকে ¯^iY করছি গভীর শ্রদ্ধায়।